রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৫৯ অপরাহ্ন
জয় ডেক্স: ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ শুক্রবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তি উৎসব ‘একটা কুঁড়িকে দেখে যেমন পুরো প্রস্ফূটিত ফুলকে ভাবা খুবই কঠিন, তেমনি ৪০ বছর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শুরুটা হয়েছিল, কুঁড়িটা হয়েছিল। কিন্ত এই ভাবে এত বড় হবে এটা আমরা ভাবিনি। এটা হয়েছে,আমি বিশ্বাস করি এটা (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র) আরো বড় হবে ’। আজ শুক্রবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, ৪০ বছর আগে আমাদের স্বপ্নের জায়গা ছিল যে, সারা দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আমরা আলো পৌঁছে দিতে চাই। সেই জন্য তারা যদি নিজে আসো খুব ভাল। আর তারা যদি না আসে আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা তার কাছে আলো দিয়ে আসবো। কিন্ত বাংলাদেশকে আলোকিত হতেই হবে। আমি তখন একবার লিখেছিলাম যে একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশ হবে। এটা শুনে সবাই তখন মুখ টিপে হেসেছিল। তারা ভেবেছিল আমি এতে বুঝাচ্ছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইট কাঠ সব বাংলাদেশ হবে। কিন্ত সেটা নয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম আমরা যে আজকে আলোকিত মানুষের স্বপ্ন দেখেছি, উন্নত মানুষের স্বপ্ন দেখেছি, একদিন সারা জাতিকে সেই স্বপ্ন দেখতে হবে। তা না হলে আমরা পঙ্কিলতা থেকে আমরা উঠতে পারবো না। আমাদের একটা বড় জাতি চাই, একটা গৌরবময় জাতি চাই, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি চাই। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে।
আলোকিত মানুষ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের হাত ধরেই সত্তর দশকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। হাটি হাটি পা পা করে ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে তার। সংগঠনটির ৪০ বছর পূর্তির আয়োজন ছিল বর্ণাঢ্য। সকাল ৯:৩০ ঘটিকায় রাজধানীর পাবলিক লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় এক বৈচিত্র্য পূর্ণ র্যালী। তাশের দেশের রাজার পোশাক পরে র্যালীর নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সঙ্গে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মোস্তফা মনোয়ার, ডেইলী স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, শিল্পী মোস্তাফা জামান আব্বাসী, টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, নাট্যভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ, টিভি ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার এবং নাগরিক টিভি’র ব্যবস্হাপনা পরিচালক রুবানা হকসহ প্রমূখ।
কার্নিভ্যাল ঢঙে বর্ণীল, মনোজ্ঞ ও সুসজ্জিত র্যালীটি ১৮টি ভাগে সাজান হয়। র্যালীর ২য় ধাপে রঙিন শাড়িতে সজ্জিত ছিলো ৩২ জন মেয়ে শিশু। বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলো, ঢাক-ঢোলবাদক দল, ভরতনট্যম, কত্থক, মনিপুরী এবং গৌড়িও নাচের দল, রংধনুর আদলে সাতটি রঙে সজ্জিত শিশুর দল, রঙিন শাড়ি পরে কলস কাখে মেয়ের দল, রোমান বাদক দলের সঙ্গে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাজে সজ্জিত দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, শিশুতোষ গল্পের চরিত্রে সজ্জিত দল, রঙিন পতাকা হাতে মানুষ ও সুসজ্জিত মোবাইল লাইব্রেরি।সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো র্যালীর নবম ভাগ। এ ভাগে ছিল বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব চরিত্র। চরিত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যিই র্যালীতে হাটছেন সফক্লিস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, ফ্রয়েড, মহাকবি ফেরদৌসী, রুমী, মহাকবি গ্যাটে, শেখ সাদী, হাফিজ। আরও ছিলেন গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, হেগেল, ডারউইন, নিউটন, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিসসহ আরও অনেকে। জোয়ান অব আর্ককেও দেখা গেছে র্যালীতে।আর বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দতম ভাগে ছিল বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের জনপ্রিয় রূপকথার বেশ কয়েকটি চরিত্র। ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, পিনোকিও, অরুন-বরুন-কিরণ-মালা, সিনডারেলা, আলাদিনের জ্বীন, এমনকি শিয়াল পন্ডিতও।র্যালি শেষে সারাদিন ব্যাপী চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, প্রিয়াংকা গোপ, চন্দনা মজুমদারসহ প্রায় ৫০ জনের অধিক শিল্পী মাতিয়ে রাখে ম । গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে গৌড়িয়, মনিপুরী, কত্থকসহ বিভিন্ন ধরণের নাচ, ফাঁকে ফাঁকে চলে আলোচনাও।
উৎসব আয়োজনে প্রায় ৩০ হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের আপ্যায়নের জন্য বাঙালিয়ানা ধাঁচে পরিবেশন করা হয় দেশিয় সব খাবার। আকর্ষণীয় বাঁশের ঝুড়িতে করে অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পাটি শাপটা, তেলের পিঠা, সিঙ্গারা, কদমা, খই, চিড়ার মোয়া, নিমকপাড়া, মুড়–লী, নকুল দানা, দানাদার, গজা, জিলিপিসহ আরও কিছু খাবার।আমন্তণপত্রটি ছিল ব্যতিক্রম ধর্মী। এতে বলা হয়, সারা দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে- “যতবার খুশি এবং প্রতিবার যতক্ষণ খুশি উপস্হিত থাকতে।” অনুষ্ঠানে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমরা পাইনি আমাদের ছেলে-মেয়েরা পেয়েছে। আমার মেয়ে ছোট বেলা থেকেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সদস্য ছিল। ও বর্তমানে প্রবাসী। আসলে অন্তত একবার হলেও ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সে। প্রবাসে থাকলেও ওর সাহিত্যজ্ঞান এবং সংস্কৃতি প্রীতি ওর ভালবাসা তৈরী করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আলোকিত মানুষ গড়ার যে উদ্যোগ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার নিয়েছিলেন তা দেশ গড়ার প্রত্যয়ে অত্যন্ত দূরদর্শী একটি ভূমিকা ছিল। আজকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের কিশোর কিশোরী এবং তরুণ তরুণীদের সুন্দর মন গঠনে বিশেষ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে।বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেটার কোন তুলনা নাই। এখন সারা পৃথিবীর সব থেকে বড় সমস্যা হল কেউ বই পড়ে না। আমাদের দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এককভাবে এই কাজটিই করে যাচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যে ৪০ বছর পূর্তি হয়ে গেল আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। মনে হয় যেন এইতো সেদিন। এমন অসংখ্য ৪০ বছর পূর্ণ করুক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এটাই চাই। আমি যদি দেখি কোন ছেলে বা মেয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যায় তবে ওর সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা হয়। এমন অসংখ্য ভাল ছেলে মেয়ে তৈরি করুক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এটিই চাই। অনেক অভিনন্দন এবং শুভকামনা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সবাইকে।ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দূরদর্শী একটি ভাবনা এবং বাস্তবায়িত সফল প্রতিষ্ঠান। আমি অত্যন্ত গর্বিত আজকে এখানে উপস্হি থাকতে পেরে। মানুষের মন পরিবর্তনে এবং সৃষ্টিশীল ভাবনার বিকাশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অবদান রেখে যাচ্ছে সুদীর্ঘ ৪০ বছর ধরে। এটি একটি বিশাল ব্যাপার। আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দীর্ঘায়ু কামনা করছি।এদিকে চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রকে সাজানো হয় বর্ণীল সাজে। উৎসব উপলক্ষে চারুশিল্পী মিলন রায়ের নেতৃত্বে একঝাঁক স্বেচ্ছাসেবী শিল্পী মাসব্যাপী কেন্দ্রকে সাজিয়ে তোলে মনোমুগ্ধকর রূপে। দেয়াল পেইন্টিং, ক্যানভাস, আলপনায় বর্ণিল করে তোলা হয় বিশ্বসাহ্যি কেন্দ্র। প্রবেশদ্বারে চমৎকার একটি তোরণ। তোরণ দিয়ে ঢুকতেই হাতের দু’পাশের দেয়ালে চোখে পড়বে নানান চিত্রকর্ম। এতে ফোক এবং রুপকথার বিভিন্ন চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে।আরেকটি টিম শিল্পী আব্দুর রহমান নূর ও সায়ইদা শারমিন সেতুর নেতৃত্বে কেন্দ্রের পুরাতন বিল্ডিং এর রেপ্লিকাসহ নানান রকম কারুশিল্পে সাজিয়ে তোলে উৎসব স্হলে। এতে ব্যবহার করা হয় কাগজের ফুল, পমপম বল, মাটির হাড়ি, মটকি, মঙ্গল প্রদীপসহ লোকজ সব উপকরণ। এছাড়াও সন্ধ্যার পর ঝলমলে আলোকসজ্জায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে কেন্দ্র।আর সবুজায়নের জন্য ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে ফ্লোরে টবে শোভা পায় নানান প্রজাতির গাছ।অনুষ্ঠানটি সাফল্যমন্ডিত করবার জন্য প্রায় ৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবক দিনব্যাপী কর্মব্যস্ত ছিল। এছাড়াও উৎসব উদ্যাপন কমিটি এবং বিভিন্ন উপকমিটির সদস্যরা প্রায় দু`মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন সুত্র:দৈনিক সকালের সময়
Leave a Reply